কক্সবাজার সৈকতে ঝুঁকি নিয়ে গোসল করছেন পর্যটকেরা, নির্দেশনা মানেন না কেউ

বিশেষ প্রতিবেদক •

ফাইল ছবি

সূর্য তখন মধ্যগগনে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টের এক কিলোমিটার এলাকায় সমবেত হয়েছেন অন্তত ৫০ হাজার পর্যটক। সেখানকার অর্ধেক পর্যটক তখন সমুদ্রের নোনা জলে নেমে গোসলে ব্যস্ত। সাঁতার জানেন না এমন অনেকেই পানিতে নেমেছেন। তাঁদের কারও পরনেই লাইফ জ্যাকেট নেই। অভিভাবক ছাড়াই অনেক শিশুকে দেখা যায়, টিউবে ভেসে গভীর সাগরের দিকে চলে যাচ্ছে।

কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এভাবে অসতর্কভাবে সমুদ্রে গোসলে নামছেন বিভিন্ন বয়সের পর্যটকেরা। সমুদ্রে গোসলের ব্যাপারে ১০টি নির্দেশনা আছে জেলা প্রশাসনের। এসব নির্দেশনার বিষয়ে পযটকদের সতর্ক করতে লিফলেট, বিলবোর্ডসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা চালায় জেলা প্রশাসন, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও লাইফগার্ড। কিন্তু পর্যটকেরা এসব নির্দেশনার ব্যাপারে উদাসীন। এতে পানিতে ডুবে পর্যটকের নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ।

সর্বশেষ গত সোমবার দুপুরে সুগন্ধা পয়েন্টে গোসলে নেমে মারা গেছেন গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার ঠিকাদার ইকবাল হোসেন (৫২)। ওই দিন দুপুরে সোয়া ১২টার দিকে টিউব নিয়ে সমুদ্রে নেমেছিলেন ইকবাল। এ সময় ঢেউয়ের ধাক্কায় টিউব থেকে ছিটকে পড়ে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হন তিনি।

দুপুর ১২টার দিকে সুগন্ধা পয়েন্টের বালুচরে কিছু স্থানে লাল পতাকা ওড়াতে দেখা যায়। সৈকতের যেসব স্থানে গুপ্তখাল কিংবা গর্ত আছে, সেখানে গোসলে নামা ঝুঁকিপূর্ণ জানাতে পতাকা ওড়ানো হয়েছে। কিন্তু লাল নিশানার আশপাশেই শত শত পর্যটক টিউবে গা ভাসিয়ে গভীর সমুদ্রের দিকে চলে যাচ্ছেন।

এ সময় সৈকতের বালুচরে একটি ওয়াচ টাওয়ারে দেখা গেল হলুদ টি–শার্ট পরা দুজন লাইফগার্ডকে। তাঁরা বাঁশি বাজিয়ে তাঁদের সতর্ক করছেন। তবে সেদিকে কারও নজর নেই। ঢেউয়ের ধাক্কায় কেউ টিউব থেকে পানিতে ছিটকে পড়লে লাইফগার্ড ও জেলা প্রশাসনের বিচকর্মীরা মুহূর্তে তাঁদের উদ্ধার করে আনছেন। তবে প্রায় ৫০ হাজার পর্যটকের এই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন লাইফগার্ড ও বিচকর্মীরা।

লাইফগার্ড ও বিচকর্মীরা বলেন, গত মঙ্গলবার বিকেলে সৈকতের সুগন্ধার উত্তর দিকে সিগাল, লাবণী পয়েন্ট এবং দক্ষিণ দিকের কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত মোট চার কিলোমিটার সৈকতে নেমেছেন অন্তত দেড় লাখ পর্যটক। আজ বুধবারের পর থেকে পর্যটক আরও বাড়তে পারে। এ ছাড়া বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর সৈকতে একসঙ্গে তিন লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটবে বলে ধারণা করছেন তাঁরা। তবে পর্যটকসংখ্যা বেড়ে গেলে তাঁদের সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ সময় পর্যটকেরাও সমুদ্রে গোসলের সময় নিয়মনীতি মানার ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। এতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

লাইফগার্ড মো. আলমগীর বলেন, ঝুঁকি নিয়ে গোসলে নেমে প্রতিদিন ২০-৩০ জন পর্যটক বিপদে পড়ছেন। জোয়ার-ভাটার সময় ও আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থা না জেনেই অনেকে সমুদ্রে নেমে যান। এমন অবস্থায় কেউ স্রোতের টানে ভেসে গেলে তাঁদের বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, নিরাপদ গোসলের বিষয়ে পর্যটকদের নানাভাবে সচেতন করা হচ্ছে। অধিকাংশ পর্যটক নিয়ম মেনে গোসলে নামেন না। একসঙ্গে কয়েক লাখ পর্যটক যখন উন্মুক্ত সৈকতে নেমে পড়েন, তখন দেড় শতাধিক ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষে সবকিছু সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে।

নিরাপদ ‘সুইমিং জোন’ নেই

সৈকতের লাবণী পয়েন্টে গোসলের জায়গা (সুইমিং জোন) নির্ধারণ করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। তবে গত জুলাই মাসে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একাধিক নিম্নচাপ ও জোয়ারের প্রভাবে লাবণী থেকে সিগাল পয়েন্টের অন্তত দুই কিলোমিটার সৈকত ভেঙে লন্ডভন্ড হয়। এরপর সেখানে গোসলের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সিগাল, সুগন্ধা ও কলাতলী সৈকতে দৈনিক ৫০ হাজারের বেশি পর্যটক গোসলে নামছেন। স্রোতের টানে কেউ ভেসে গেলে উদ্ধারের জন্য এই চার কিলোমিটার সৈকতে আছে বেসরকারি লাইফগার্ড সি সেফের ২৬ জন ও জেলা প্রশাসনের ৩০ জন বিচকর্মী। কলাতলী থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত অবশিষ্ট ১১৬ কিলোমিটার সৈকতের ২০টির বেশি পয়েন্টে হাজার হাজার পর্যটক গোসল করেন। তবে সেখানে কেউ ভেসে গেলে উদ্ধারের জন্য কেউ নেই।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটিজ ফোরামের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, সৈকতে সৃষ্ট গুপ্তখাল কিংবা বড় গর্তে আটকা পড়ে গত ১৮ বছরে ১২৪ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। কক্সবাজারের হোটেল–রেস্তোরাঁ মালিক ও পর্যটন ব্যবসায়ীদের সবাই সেবার নামে টাকা কামাই করতে ব্যস্ত। পর্যটকদের নিরাপত্তা, বিনোদন, নিরাপদ গোসল নিয়ে কারও চিন্তা নেই। প্রশাসনেরও তেমন গরজ নেই। সৈকতের ২০০-৫০০ মিটার এলাকাকে জাল দিয়ে ঘিরে ‘সুইমিং জোন’ গড়া যায়নি। দীর্ঘ চার যুগেও একজন ডুবুরি নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। আবার সমুদ্রে গোসলে নেমে কেউ মারা গেলে সেটার দায়ও কেউ নেন না।

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, পর্যটকের নিরাপদে গোসলের জন্য সুইমিং জোন এবং ডুবুরি প্রয়োজন। এ বিষয়ে সৈকত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গঠিত বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।